এই সাঁঝের বেলাও চারপাশটা কেমন জানি নির্বাত, নিস্তব্ধ। নির্ভার চোখে অস্পষ্ট অন্ধকারে গাছগুলো আকাশ পানে চেয়ে আছে। দূর থেকে ভেসে আসা কুকুরের ডাক ছাড়া সবটাই যেন বোবা হয়ে আছে।সংজ্ঞাহীন অনুভূতিতে পথটাও বুক চিতিয়ে ভাবনায় ডুবে। মৃদুমন্দ বাতাস যেন তার যৌবন খুইয়েছে। প্রকৃতির সারা গা জুড়ে এক মায়ার পরশ নেমেছে। নির্বাত এ সময়ে কেউ কাউকে দেখার নেই।
-তবুও কেউ দেখছো না তো?
যাক বাবা! এই মহামারীর সুযোগে ত্রাণের রসদ মেরে কিছুটা আয়- ইনকাম বাড়ানো যাবে। এটা ভাবতেই যেন শরীর দিয়ে উষ্ণ তরঙ্গ বয়ে গেল। আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে।
যাই মাল নিয়ে ঝটপট সটকে পড়ি।
-ঘেউ ঘেউ….
-এই ব্যাটা কুকুর ,পথ ছেড়ে সরে দাঁড়া।
-ঘেউ ঘেউ .. পথ ছাড়বো না।
-একি অবাক কান্ড..! কুকুর আবার কথা বলতে পারে নাকি। স্পষ্টত শুনলাম।
– ঘেউ ঘেউ… আমি কথা বলতে পারিনা। তবে তোমার মতো চোরদের শিক্ষা দিতে চাইলে বলতে পারি। তোমার এই নিচু কাজ দেখে নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারলাম না। নিজের সীমালংঘন করে ও কিছু কথা তোমাকে শোনাতে চাই।
পৃথিবীর সৃষ্টিকুলের মধ্যে শুধু তোমরা কথা বলতে পারো। উন্নত মস্তিস্ক তোমাদের। এই বুদ্ধি আর কথার জোরে পৃথিবীটাকে শাসন করছো তোমরা। আমি সহ আমাদের জাত, জীবজন্তু, বৃক্ষরাজি সবাই তোমাদের সেবা করি। তোমাদের চোখে আমি নিম্ন শ্রেণীর প্রাণী । একটু খাবার পেলেই তোমাদেরকে আমি ভুত্য মানি। কৃতজ্ঞতায় তোমাদের অনেক কাজ করে দেই, এলাকা পাহারা দেই। ঘুরতে ঘুরতে এমন কিছু জিনিস দেখি , যা দেখে খুব হতাশ হই। শ্রেষ্ঠত্বের কথা ভুলে তোমরা এমন সব কাণ্ড করে বসো যে, তোমাদের স্থান আমার থেকেও নিচে নেওয়া যায়।
তোমার মত পাতি নেতাদের জ্ঞানহীন কাজে আমার খুব হাসি পায়। মাঝে মাঝে খুব প্রতিবাদী হয়ে ওঠি ! কেন তোমাদের নিম্ন শ্রেণীর প্রাণী বলা হয় না? আমাদের পরিচয়টাতো তোমাদের হওয়া উচিত, যারা জনগণের রক্ত শুষে দেশসেবকের খোলস পরো।
সেবকের রং মেখে কোট টুপি পরে জনগণের কাছে ভোট ভিক্ষা করো। মিথ্যে ইস্তেহারের কথা বলো।জনগণ তোমাদের ভরসা করে নেতা বানায়, আর তাদের পিঠেই ছুরি বসাও!
খেটে খাওয়া দিনমজুর ,পোশাক শ্রমিক, কলকারখানার শ্রমিক ,আর প্রবাসীদের রক্ত ঘামের পয়সা দিয়ে দেশের অর্থনীতির ভান্ডার সমৃদ্ধ হয়। তাদের কর্মের পয়সার জোরেই তোমাদের পেট চলে, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে নরম বিছানায় শুয়ে থাকো। নিত্যনতুন সাহেবী পোশাক আর গাড়িতে চড়ে ফরমায়েশ করো। তোমাদের জীবন দিব্যি চলে।
অথচ দুর্যোগের এই সময় যখন তাদের আয় রোজগার বন্ধ হয়ে না খেতে পাওয়ার অবস্থা ,তখন তাদের ত্রাণ তোমরা মেরে খাও। পেটে ক্ষুধা নিয়ে শ্রমিকরা যখন নিজেদের বেতনের দাবিতে রাস্তায় শুয়ে থাকে ,তখন তোমাদের ছায়ায় থাকা মালিকরা দরজা বন্ধ করে দেয়। তাদের রক্ত তখন চোখের পানি হয়ে গড়িয়ে পড়ে। তোমাদের দিকে সাহায্য চাইলে , টাকার গন্ধ শুঁকে পিঠ দেখিয়ে দাঁড়াও।
আশ্চর্য দেশসেবা তোমাদের! আশ্চর্য আদর্শ তোমাদের!
কাল রাতে বিষু মুচির বাড়ির পাশ দিয়ে আসার সময় ভেতর থেকে অস্ফুট আর্তনাদ ভেসে আসছিলো। দুদিন ধরে শুধু জল খেয়ে আছে। আব্দুল মিয়ার রিক্সা মাসখানেক ধরে চলছে না, বাড়িতে চাল নেই ডাল নেই। শুয়ে শুয়ে সে উপরওয়ালাকে ডাকছিলো। রহমত হকারের বাচ্চা মেয়েটা খাবারের জন্য কান্নাকাটি করছে। অসুস্থ আক্কেল খুঁড়ো ধরেই নিয়েছে শেষ জীবনটা না খেয়েই যাবে। রহিম ব্যাপারী উপায়ন্তর না পেয়ে যখন দোকান খুলতে গেছিলো , প্রশাসনের লোকজন কান ধরিয়ে কি অপমানটাইনা করলো!মহি পাগলী ভীক্ষা না পেয়ে আল্লাহকে ডেকে কেঁদে বুক ভাসায়। এই দুর্যোগের সময় আমিও খুব ক্ষুধার্ত আছি, তাই ক্ষুধার যন্ত্রণা বুঝি। দুস্থ মানুষের প্রাণের মত হীন কাজ দেখে তোমাদেরকে খুব করুণা হয়,খুব লজ্জা লাগে উন্নত জীব বলতে। ক্রান্তিলগ্নে সাধারণ মানুষের পাশে না দাঁড়াতে পারলে কিসের নেতা তোমরা? কিসের তোমাদের দেশসেবা?
-ঘেউ ঘেউ… তোমার জন্য খাবার নিয়ে এসেছি।
-এইযে কুকুরগুলোকে দেখছো নিম্ন শ্রেণীর প্রাণী হয়েও একে অপরের সাহায্যে এগিয়ে আসে নিঃস্বার্থে। আর তোমরা স্বজাতির সাহায্য না করে উল্টো তাদের হক মেরে খাও! তাহলে কি ধরে নেব তোমরা আমাদের থেকেও নিচু শ্রেণীর?
এই তোরা চল বাজারের কুকুরটা না খেতে পেয়ে ও অসুস্থ হয়ে শুয়ে আছে । আমার খাবারটা ওকে দিয়ে আসি।
লেখক: হাদিউল ইসলাম
শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
Leave a Reply